মোঃ রুহুল আমিন,
জেলা প্রতিনিধি জয়পুরহাটঃ
জয়পুরহাটে বর্তমানে ৬৫১টি লেয়ার (ডিম উৎপাদন) মুরগির খামার রয়েছে— যেখানে বছরে ডিম উৎপাদন হচ্ছে ৩১ কোটি। জেলায় চাহিদা ৯ কোটি ৯৪ লাখ। উৎপাদিত এই ডিমের বাজার মূল্য এখানে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার উপরে।
কৃষি নির্ভর অর্থনীতির উপর ভর করে চলা জয়পুরহাট জেলায় চাহিদার চেয়ে বেশি ডিম উৎপাদন হচ্ছে। এতে তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। সরকারি-বেসরকারি বহুমুখী প্রচেষ্টায় বড় হচ্ছে জেলার কৃষি অর্থনীতির পরিসরও।
জয়পুরহাটে বর্তমানে ৬৫১টি লেয়ার (ডিম উৎপাদন) মুরগির খামার রয়েছে— যেখানে বছরে ডিম উৎপাদন হচ্ছে ৩১ কোটি। জেলায় চাহিদা ৯ কোটি ৯৪ লাখ। উৎপাদিত এই ডিমের বাজার মূল্য এখানে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার উপরে।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমানে জেলার চাহিদা মিটিয়ে ২০ কোটির বেশি ডিম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সহবরাহ করা হচ্ছে। মুরগি পালনের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জেলার আড়াই লক্ষাধিক মানুষ জড়িত।
তাদের মধ্যে একজন হলেন জয়পুরহাট সদর উপজেলায় জামালগঞ্জ এলাকায় মঞ্জুরুল ইসলাম।
তার খামারে ডিম উৎপাদনকারী প্রায় ৮ হাজার মুরগি আছে। এখান থেকে প্রতিদিন অন্তত সাড়ে ৩ হাজার ডিম উৎপাদন হয়। গত মাস থেকে এই খামারে প্রতি পিস ডিম বিক্রি হয়েছে ১০ টাকার উপরে।
মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, মুরগির খাবার ও মেডিসিনের বাজারে সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই। এ কারণে ডিমের বাজার চড়া।
তিনি বলেন, “তবে আমরা চাই বাজার স্থিতিশীল থাকুক। কারণ বাজার ওঠা-নামা করলে ব্যবসায় লোকসানের আশঙ্কা বেশি থাকে।”
২২ বছর ধরে মঞ্জুরুলের তিনতলা খামার দেখাশোনা করছেন আনিসুর রহমান। তিনি জানান, হাইব্রিড জাতের মুরগি ১৪০ দিনেই ডিম দেওয়া শুরু করে। ১৮ মাস পর্যন্ত ভালোভাবে ডিম দেয়। এরপর এসব মুরগি ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে বাজারে বিক্রি করা হয়।
ডিম উৎপাদনের সাথে জড়িত একাধিক খামারি বলেন, খাবারের মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন প্রতি পিস ডিম উৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে ৯ টাকার উপরে। বাজারে গিয়ে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকায়।
২০০০ সালের পর মূলত জয়পুরহাটে পোল্ট্রি বিপ্লব ঘটে। এরপর থেকেই জামালগঞ্জের অধিকাংশ বাড়িতে মুরগি পালন শুরু হয়। পোল্ট্রি ছাড়া জয়পুরহাটে অন্য কোনো শিল্প খুব বড় পরিসরে গড়ে ওঠেনি। এ শিল্পে জেলায় দিনে ৪ থেকে ৪.৫ কোটি টাকার লেনদেন হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
বর্তমানে পোল্ট্রি খাতে অনেক শিক্ষিত যুবক যুক্ত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সদরের মাদারগঞ্জ এলকার দেলোয়ার হোসেন।
দুই হাজার ডিম উৎপাদনকারী মুরগি রয়েছে তার খামারে। দেলোয়ার জানান, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা সফল হওয়ার কারণে জেলায় মুরগি পালনের বিল্পব ঘটেছে বলা যায়। এ কারণে এখানে অনেক মানুষ তাদের কর্মের পথ বেছে নিয়েছেন।
“নিরাপদ উপায়ে ডিম বাজারজাতকরণে আমাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে,” যোগ করেন দেলোয়ার।
ডিম উৎপাদন কিংবা পোল্ট্রি ব্যবসায়ের উন্নয়নে আধুনিক ব্যবসাবান্ধব পদ্ধতিতে কাজ করে যাচ্ছে জয়পুরহাটের বেসরকারি সংস্থা জাকস ফাউন্ডেশন। তাদের অর্থায়ন করছে আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ), পল্লীকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ডেনিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ডানিডা)।
রুরাল মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্টের (আরএমটিপি) মাধ্যমে মুরগি পালনের সাথে জড়িত ১০ হাজার মানুষের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়ে কাজ করছে জাকস।
জয়পুরহাটে পোল্ট্রি সেক্টরের টেকসই উন্নয়নে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জাকসের নির্বাহী পরিচালক মো. নূরুল আমিন বলেন, “এই প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা নিরাপদ ও টেকসই বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই। একই সাথে নিরাপদ পণ্য বাজারজাতকরণের উদ্যোক্তাও তৈরির কাজ করা হচ্ছে।”
জেলায় নিরাপদ উপায়ে উৎপাদিত মাংস ও ডিম বিক্রির জন্য গ্রিন হারভেস্ট মিট নামের একটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। সংস্থাটির ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম জানান, “নিরাপদ উপায়ে মাংস ও ডিম উৎপাদনকারী ৬০ থেকে ৭০টি খামার রয়েছে। আমরা তাদের কাছ থেকেই পণ্য কিনি। এসব পণ্য স্থানীয় বাজারসহ রাজধানীর ইউনিমার্টে সরবরাহ করে থাকি।”
ইউনিমার্টে প্রায় এক বছর ধরে তারা ডিম ও মাংস সরবরাহ করছেন বলে জানান শহিদুল।
বেরসকারি একটি কোম্পানির চাকরি ছেড়ে জয়পুরহাটে এসে ডিমের ব্যবসা করছেন মো. রাশেদুজ্জামান। তিনি প্রতি মাসে অন্তত ১০ ট্রাক (ডিমবহনকারী ছোট যান) ডিম ঢাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে সরবরাহ করেন।
এই উদ্যোক্তা জানান, “১৬টি খামারির কাছ থেকে মাসে কয়েক লাখ ডিম ঢাকায় সরবরাহ করি। জাকস আমাদের ডিম বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে। চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় এখন খুব ভালো আছি।”
জয়পুরহাটে সোনালী মুরগির বিপুল সংখ্যক খামার গড়ে উঠেছে। এ কারণে এখানে ডিম থেকে সোনালী জাতের বাচ্চাও ফুটোনো হয়। গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক হ্যাচারিও। মুরগির খাদ্য উৎপাদনের জন্য রয়েছে ১০টির বেশি ফিড মিল। হ্যাচারিগুলো থেকে বছরে সোনালী জাতের মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন হয় প্রায় ১০ কোটি। জেলায় মুরগীর খামারিদের বাচ্চার চাহিদা ৬ কোটির উপরে। বাকি বাচ্চাগুলো জেলার বাইরে সরবরাহ করা হয়। দিন দিন এই খাতে বাড়ছে কর্মসংস্থান।
দেশব্যাপী নিরাপদ উপায়ে উৎপাদন সফল উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে পিকেএসএফ। দেশের জয়পুরহাট, বগুড়া, নওগাঁ, রংপুর, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, শরিয়তপুর, ফরিদপুর, কক্সবাজারসহ ১২টি জেলায় আরএমটিপি প্রকল্পের মাধ্যমে ৮৬,৫৫৫ জন মানুষকে সেবার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
পিকেএসএফের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল কাদের জানান, “আমাদের আশপাশের অনেকে এখন নিরাপদ পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদন করছে। আমরা প্রত্যাশা করি, দেশের সবাই নিরাপদ পণ্য তৈরি করবে। তখন বাজারে একটি মৌলিক পরিবর্তন আসবে। আশানুরূপ একটি পরিবর্তন আসুক নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে— যা হবে সাসটেইনেবল এগ্রিকালচার সিস্টেম।”
জয়পুরহাটের অর্থনীতি, কৃষি নির্ভর উল্লেখ করে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মহির উদ্দিন বলেন, এখানে মুরগি পালনকে কেন্দ্র করে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। তাদের উৎপাদিত পণ্য দেশের মানুষ গ্রহণ করছে। সুতরাং, এই বাজার ব্যবস্থা ধরে রাখতে হবে।
“নিরাপদ উপায়ে এখানে ডিম ও মাংস উৎপাদন হচ্ছে— এই বিষয়টি একবার প্রমাণ করা গেলে আজীবন জেলার মানুষ উপকৃত হবেন। এ কারণে আমরা নিরাপদ উপায়ে উৎপাদনের জন্য চাষীদের সাথে কাজ করে যাচ্ছি,” যোগ করেন তিনি।